স্টাফ রিপোর্টার : ফরিদপুরের মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নে গত ১৮ এপ্রিল রাতে সংঘটিত ঘটনা নিয়ে জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে। এ প্রতিবেদনে প্রতিমার শাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটলেও তার রহস্য উদঘাটিত হয়নি। তবে শ্রমিকরা এ কাজ করেনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। এ ঘটনায় ওই এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান শাহ্ আসাদউজ্জামান, ইউপি সদস্য অজিত বিশ^াস ও অমৃত কুমার বসু নামে এক গ্রাম পুলিশের এক সদস্য বিরুদ্ধে শ্রমিকদের বেধে নির্যাতন করার সত্যতা পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হযেছে জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশ মার ধোর শুরু করায় গ্রামবাসী শ্রমিকদের উপর আক্রোশে ফেঁটে পড়ে। ওই প্রতিবেদনে এ জাতীয় ঘটনা তাৎক্ষণিক ভাবে মোকাবিলার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গ্রাম পুলিশ ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয় মন্দিরে প্রতিমার শাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। তবে এ ঘটনার কোন প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। আগুন নেভাতে গ্রামবাসীদের সাথে পঞ্চপল্লি সার্বজনীন কালী মন্দির সংলগ্ন পঞ্চপল্লি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াশ বøক নির্মানে নিয়োজিত শ্রমিকরাও বালতি হাতে অংশ নেয়।
তবে ওই এলাকাটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অধ্যুষিত হওয়ায় আগুন দেওয়ায় গ্রামবাসী নির্মাণ শ্রমিকদের সন্দেহ করে। এ সন্দেহ থেকে গ্রামবাসী তাদের বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে নিয়ে দড়ি দিয়ে বেধে রাখে। এ খবর পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও গ্রাম পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। তারা শ্রমিকদের এ আগুন লাগানোর জন্য দায়ি করে তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করে। এ সময় ওই দুই জন প্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশ শ্রমিকদের কিল চড় থাপ্পড় মারেন। নির্বাচিত দুই জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশের এ আচরণ উস্কানি হিসেবে কাজ করে।
এতে গ্রমাবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তবে ওই কক্ষে ওই শ্রমিকরা ছাড়া ইউপি চেয়ারম্যান, গ্রাম পুলিশ ও স্থানীয় তিন শিক্ষক ল²ীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রভাষ কুমার বিশ^াস, ডুমাইন শহীদ মফিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তম কুমার বিশ^াস ও পঞ্চপল্লি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ^াসসহ ৮-১০ জনের বেশি লোক ছিল না। গ্রামবাসি কক্ষের বাইরে অবস্থান করে ইট ছুড়তে থাকেন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তবে ঘটনাটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আসাদউজ্জামান পুলিশকে খবর দেয়।
ঘটনার পরবর্তিতে ইউপি চেয়ারম্যান জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সকলের পাশে থেকে আহত শ্রমিকদের উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করেন। পরবর্তিতে তদন্তকাজেও সহায়তা করেন। তবে পরবির্তিতে এ ঘটনার তিনটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় দুই জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশের কর্মকান্ড ফাঁস হয়ে যায়। এরপর ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য আত্মগোপন করেন এবং গ্রাম পুলিশকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। এ তদন্ত কমিটির আহŸায়ক মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী গত রবিবার দুপুরে বলেন, আসলে ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য ‘সর্প হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়ার’ ভুমিকায় ছিলেন। তাদের এ নিঁখুত অভিনয় আমরা শুরুতে বুঝতে বা ধরতে পারিনি।
তিনি বলেন, এ ঘটনায় চাঁদাবাজী কিংবা ইভটিজিং কিন্তু এলাকায় আধিপত্য বিস্তার সংক্রান্ত কোন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও গ্রাম পুলিশ দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও গ্রাম পুলিশ দায়িত্বশীল ভুমিকা রাখলে এ ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল। তাদের উচিত ছিল শ্রমিকদের মধুখালী থানায় নিয়ে যাওয়া। তদন্ত কমিটি এ ঘটনার জন্য ডুমাইন ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য শাহ্ আসাদউজ্জামান এবং ইউপি সদস্য অজিত বিশ^াস ও গ্রাম পুলিশ অমৃত কুমার বসুকে ওই প্রতিবেদনে দায়ি করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয় মন্দির ও স্কুলটি আনুমানিক ৫০ গজের মধ্যে পাশাপাশি অবস্থিত। গত এক মাস ধরে নির্মাণ শ্রমিকরা স্কুলে কাজ করছিলেন। মন্দিরটি ছিল অরক্ষিত। ওই এলাকার পাঁচটি গ্রামে অন্য সম্প্রদায়ের কোন লোক বসবাস করেন না। ওই দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রতিমার শাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এর ১৫ মিনিট পর নসিমনে করে নির্মাণ কাজের লোহা আনা হয়। ওই সময় ঘটনাস্থলে অল্প কয়েকজন লোক উপস্থিত ছিলেন। নসিমনের দড়ি দিয়ে শ্রমিকদের বাধা হয়। নসিমন চালক লিটন শেখকে গ্রাম পুলিশ প্রথমে চর থাপ্পর মারেন। পরে ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য শ্রমিকদের চর থাপ্পর মারা শুরু করেন প্রতিমায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য।
তদন্ত কমিটি আগামীতে এ জাতীয় ঘটনা এড়ানোর জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রত্যেক মন্দির ও বিদ্যালয় সি সি ক্যামেরার আওতায় আনা। মসজিদ মন্দিরসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য উচু প্রাচিল দেওয়া। তাৎক্ষণিকভাবে এ জাতীয় ঘটনা কিভাবে মোকাবিলা করা যায় এ জন্য জনপ্রতিনিধি, গ্রাম পুলিশ ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। যে এলাকায় একই ধর্মের লোক বেশি বসবাস করেন সে এলাকায় অন্য ধর্মের কোন ব্যাক্তি বা ব্যক্তিগণ কাজ করতে গেলে আগে থেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিদের এ বিষয়ে জানিয়ে রাখা। ধর্মীয় সম্প্রতি বজায় রাখতে প্রতিনিয়ত প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া।
গত ১৮ মে পঞ্চপল্লির ঘটনার পর জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) কে আহŸায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। এই কমিটিকে তিন কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। এ কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন, সহকারি পুলিশ সুপার (মধাখালী সার্কেল) মিজানুর রহমান ও মধুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. ইউসুফ আলী। ১৯ এপ্রিল থেকে এ কমিটি কাজ শুরু করলেও তিন দিনে প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে পারেনি। পরে দুই দফা সময় বাড়িয়ে গত বৃহস্পতিবার (৯ মে) জেলা প্রশাসকের কাছে এ প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়।
মামলা
এ ঘটনা নিয়ে হত্যা, পুলিশের উপর হামলা ও প্রতিমার কাপড়ে আগুন দেওয়ার ঘটনায় মোট তিনটি মামলা হয়। মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মিরাজ হোসেন গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে বলেন, এ পর্যন্ত পুলিশের উপর হামলার মামলায় ৩১জন ও হত্যা মামলায় ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের উপর হামলার মামলায় এ পর্যন্ত ৪ জন এবং হত্যা মামলায় ৭ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান ও ইউপি সদস্য অজিত বিশ^াসকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান অব্যাহ রয়েছে।
Leave a Reply