স্টাফ রিপোর্টার : গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন উপজেলা নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনীত প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহকে বসিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ভাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আক্রামুজ্জামান ওরফে রাজা। এ কাজে তার সহযোগী ছিলেন ভাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুর রহমান হাওলাদার ওরফে মিরন। মিরনকে নিক্সন চৌধুরী ‘মামা’ বলে সম্বোধন করেন।
ফরিদপুর-৪ আসনের বর্তমান স্বতন্ত্র দলীয় সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সনের সাথে ভাঙ্গা উপজেলা লীগের সাধারণ সম্পাদক আক্রামুজ্জামান ওরফে রাজার ফাঁস হওয়া ফোনালাপ থেকে এ তথ্য জানা গেছে। শুক্রবার দুপুরে এ ফোনালাপটি হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হওয়ার পর ভাইরাল হয়ে যায়। ভাইরাল হওয়া ওই ফোনালাপটি তিন মিনিট ৩৪ সেকেন্ডের। এর মধ্যে গত জাতীয় নির্বাচনে কাজী জাফরউল্লাহকে বসিয়ে দেওয়ার কথপোকথনের অংশটি নিচে দেওয়া হল।
নিক্সন:কেন আপনি বলেন নাই জাফরুল্লাহ সাহেব বইসা পড়বে। আমারে কি দিবেন? যে বসে নাই তো।
রাজা: না,না। বসার সব ব্যবস্থা হয়েছিল না? চার পাঁচ দিন সে বন্ধ ছিল না সবকিছু?
নিক্সন: সেটা তো উনি অসুস্থ ছিলেন। মুরুব্বি মানুষ।
রাজা: না, না অসুস্থ না।
নিক্সন: আপনি বলছেন যে আমি আর মিরন (ভাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুর রহমান হাওলাদার ওরফে মিরন) মামা বসায় দেব। এই কথা বলেন নাই ? আপনি তো বসাইতে পারেন নাই।
রাজা: হ্যাঁ, হ্যাঁ আমরা বলছি। আমরা চেষ্টা করছি। চার-পাঁচদিন বন্ধ ছিল। উনি নির্বাচন শেষ পর্যন্ত কতদিন করতে পারছিল? আমরা তো চেষ্টা করছিলাম। আমি আপনারে যেটুক বলছিলাম। সেটুক দেখছিলেন না দৃশ্যত হওয়ার পথে ছিল? লাস্টে সে তার সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করে ফেলেছিল।
প্রথমে আক্রামুজ্জামান ফোন করেন নিক্সকে। কিন্তু নিক্সন ফোনটি ধরেননি। পরে মিসড কল থেকে নিক্সন ফোন করেন আক্রামুজ্জামানকে ।
কথপোকথনের শুরুতে বর্তমান উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে কথা শুরু করেন আক্রামুজ্জামান। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শেষ পর্যন্ত থাকতে পারবে না এ দিয়ে শুরু হয় তাদের কথা।
রাজা: হ্যালো
নিক্সন: ফোন দিছিলেন নাকি, মিসড কল পাইলাম।
রাজা: ফোন দিছিলাম মানে কি শুনেন….. শেষ পর্যন্ত ও থাকতে পারবে না।
নিক্সন: না না না। আপনি মানুষ ভাল না। আপনারে যে মানুষ কয় যে চিটার বাটপার। আসলেই রাজা সাহেব আপনি ভাল মানুষ না।
রাজা: আপনি এইভাবে কথা কইলে আমি কষ্ট পাব।
নিক্সন:আপনি আমারে এই ফোন-টোন দেবেন না। আপনার সাথে আর কথা বলার দরকার নাই। রাজনৈতিক মাঠে আপনি বিপদে পড়লে যেকোনও সময় আমারে ফোন দেন। আপনার উপরে আমার বিশ্বাস নাই। আসলে ওরাও বিশ্বাস করেনা, আমিও আপনারে বিশ্বাস করিনা।
রাজা:না না না….
নিক্সন: ওইপক্ষেই আপনি সৎভাবে থাকেন। ওদের খবর আমারে দেওয়ার দরকার নাই। আমি রাজনীতি করি। এসব খবর-টবর আমার লাগেনা।
রাজা:আমি একটা কথা বলি।
নিক্সন: আর কথা বলার দরকার নাই। আমি আপনারে চিনে ফেলছি।
রাজা: না।না, না। আপনি বলেন এই একটা বিষয়…
নিক্সন: না,না, না। আপনার কথাবার্তা ভাল না। আপনি আসলেই একটা চিটার টাইপের মানুষ। আমি আপনারে ভুল বুঝছি।
রাজা:না। আমি, আমি…
নিক্সন: শুনেন, শুনেন ভাই। আমি রাজনীতি করি মানুষের জন্য জনগণের জন্য। কথা বুচ্ছেন। উন্নয়ন করার জন্য। আমারে ভয় দেখাবে জাফরুল্লাহ। আজ পর্যন্ত জাফরুল্লাহই ভয় দেখাইতে পারে নাই। আর এই চিটার বাটপার কি দেখাবে। আমারে এসব বইলেন না। আপনাদের দলের মধ্যে সব দুই নাম্বার। দুই নাম্বারি করেন। দুই নাম্বারি কইরা আপনারা নিজেরা নিজেরা কোন্দল করেন,নিজেরা ঝামেলা করেন। কথা বুচ্ছেন। এটা আপনাদের ব্যাপার। আমার না। আমি আপনাকে চিনে ফেলছি। আপনি আর ভবিষ্যতে আমারে ফোন-টোন দিয়েন না। রাজনীতির মাঠে দেখা যাবে।
রাজা: আমি আপনারে একটা কথা বলি।
নিক্সন: আপনি জাতীয় নির্বাচনের আগেও যত ইনফরমেশন দিছেন অর্ধেক ভুল দেন, অর্ধেক ঠিক দেন। আপনি তাল-বেতাল কইরা ফেলেন।
রাজা: আমি যেটুক দিছিলাম (ইনফরমেশন) সেটুক আপনি শেষ পর্যন্ত তো সবই দেখলেন..
ওই ফোনালাপে নিক্সন সর্বশেষ আক্রামুজ্জামানকে বলেন, ঠিক আছে। আপনি আর আমারে ফোন-টোন দিয়েন না। আপনি আপনার মত রাজনীতি করেন। আমরা আমাদের মত। এগুলা আর দরকার নাই এখন আর আসলে। ঠিক আছে?
এ ব্যাপারে আক্রামুজ্জামানের বক্তব্য জানার জন্য শুক্রবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্তত সাতবার ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু ফোন না ধরায় ক্ষুদে বার্তা দিয়েও তার বক্তব্য জানা যায়নি।
এ ব্যাপারে কথা হয় ভাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুর রহমান হাওলাদার ওরফে মিরনের সাথে। ‘নিক্সনের সাথে কথপোকথনের ওই গলা আক্রামুজ্জামানের’ নিশ্চিত করে তিনি এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুন উর রশীদ বলেন, তিনি নিক্সনের সাথে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কথপোকথনের সংক্রান্ত অডিও ভাইরাল হয়েছে বলে জানতে পেরেছেন। তবে তিনি নিজে সেটি শোনেন নি। তিনি বলেন, বর্তমান প্রযুক্তির যুগে নানাভাবে টেম্পারিং করা হয়।
সংসদ সদস্য নিক্সন চৌধুরী একবার নিজেও তার বক্তব্য টেম্পারিং করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ করেছিলেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুন উর রশীদ বলেন, তিনি কথপোকথন শুনবেন। যদি ওই কন্ঠ উপজেলা আওয়ামী লগের সাধারণ সম্পাদকের হয়ে থাকে তাহলে দলের আদর্শ, নীতি ও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রসঙ্গত গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনে ফরিদপুর-৪ আসন থেকে এক লাখ ৪৮ হাজার ৩৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে হ্যাট্রিক করেন মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন। অপরদিকে কাজী জাফর উল্যাহ এক লাখ ২৪ হাজার ৬৬ টি ভোট পেয়ে নিক্সনের কাছে (২০১৪, ২০১৮, ২০২৪) হ্যাট্রিক পরাজয় বরণ করেন।
Leave a Reply