স্টাফ রিপোর্টার : আড়াই হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে ফরিদপুরের বহুল আলোচিত দুই ভাইসহ ৪৭ জনের নামে দেওয়া সম্পূরক অভিযোগপত্র (চার্জশিট) গ্রহণ করেছেন আদালত। গতকাল সোমবার (২২ এপ্রিল) দুপুর ১টার দিকে ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামস জগলুল হোসেন এ আদেশ দেন। এ সময় কারাগারে থাকা দুই ভাই শহর (পৌর) আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বরকত ও ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মো. ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেল এবং সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের সহকারি (ব্যক্তিগত একান্ত সচিব) এ এইচ এম ফুয়াদকে আদালতে হাজির করা হয়। অন্যদিকে জামিনে থাকা সাত আসামি আদালতে হাজির হন।
এদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের ভাই ফরিদপুর সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহতাশেম হোসেন ওরফে বাবর উপস্থিত ছিলেন। সম্পুরক এজাহারপত্র গ্রহণের পাশাপাশি আদালত জামিনে থাকা আসামিদের জামিনের মেয়াদ বর্ধিত করেন এবং বাকি ৩৭ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন আদালত। আদালত মামলার পরবর্তি তারিখ ধার্য করেছেন আগামী ৩০ মে। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল বলেন, এ সম্পূরক অভিযোগপত্র নিয়ে আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ ও বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে যুক্তি পাল্টা যুক্তি তুলে ধরা হয়। পরে আদালত সম্পূরক অভিযোগপত্র গ্রহণসহ উল্লেখিত সিদ্ধান্ত দেন।
এ মামলার প্রথম যে ১০জনের নামে এজাহার দেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে বাবর, বরকত, রুবেল ও ফোয়াদ ছাড়া অপর আসামিরা হলেন, ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি নাজমুল ইসলাম খন্দকার লেভী, শহর যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসিবুর রহমান ফারহান, ফাহাদ বিন ওয়াজেদ ওরফে ফাহিম, কামরুল হাসান ডেভিড, মুহাম্মদ আলি মিনার ও তারিকুল ইসলাম ওরফে নাসিম। আড়াই হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে ২০২০ সালের ২৬ জুন বরকত ও রুবেলের বিরুদ্ধে রাজধানীর কাফরুল থানায় মামলা দায়ের করেন সিআইডির পরিদর্শক এস এম মিরাজ আল মাহমুদ। ২০২১ সালের ৩ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ কমিশনার (এএসপি) উত্তম কুমার সাহা সিএমএম আদালতে এ মামলায় ১০ জনের নামে প্রথম অভিযোগপত্র জমা দেন।
একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর এ মামলায় ১০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট গ্রহণ করে আদেশ দেন ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ কে এম ইমরুল কায়েশ। এরপর মামলাটি বদলি হয়ে বিশেষ জজ আদালত-৯ এ আসে। এ আদালতে ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর চার্জ শুনানির দিনে চার্জশিটে কিছু অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিকে আদেশ দেন। সে অনুযায়ী গত বছর ২২ জুন মোট ৪৭ জনকে অভিযুক্ত করে নতুন করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা-সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন। এরপর অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণের জন্য গত বছর ৫ জুলাই এখতিয়ার সম্পন্ন সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে পাঠিয়ে দেন বিশেষ জজ আদালত-১০ এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ফরিদপুরে এলজিইডি, বিআরটিএ, সড়ক বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কাজের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন বরকত ও রুবেল। এছাড়া মাদক ব্যবসা ও ভূমি দখল করে অবৈধ সম্পদ গড়েছেন তারা। ২৩টি বাস, ট্রাকসহ বিলাসবহুল গাড়ির মালিক হয়েছেন ওই দুই ভাই। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন তারা। এজাহারে আরও বলা হয়, ২০২০ সালের ১৮ জুন মিরাজ আল মাহমুদ তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, বরকত ও রুবেল অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন।
এ মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্রে নতুন করে যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন, ফরিদপুর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র অমিতাব বোস, জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক অনিমেষ রায়, ফরিদপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র শেখ মাহতাব আলী, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ সম্পাদক দীপক কুমার মজুমদার, সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের সাবেক এপিএস সত্যজিৎ মুখার্জি, জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি গোলাম মো. নাছির,
কানাইপুর ইউপি আওয়ামী লীগের সাবেক সম্পাদক ও কানাইপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ফকির মো. বেলায়েত হোসেন, বরকতের স্ত্রী আফরোজা আক্তার পারভীন, রুবেলের স্ত্রী সোহেলী ইমরুজ পুনুম, জেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক জাহিদ বেপারী, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি খলিফা কামাল, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক সাহেব সারোয়ার, নারী ও শিশু নর্িাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি স্বপন কুমার পাল, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীম, সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল ইসলাম, ফরিদপুর পৌরসভার কাউন্সিলর মো. আব্দুল জলিল শেখ, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি ও দৈনিক ঢাকা টাইমস পত্রিকার সম্পাদক সাংবাদিক মো. আরিফুর রহমান ওরফে দোলন।
প্রসঙ্গত ২০২০ সালের ১৬ মে রাতে ফরিদপুরে জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে দুই দফা হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১৮ জুন অজ্ঞাত ব্যাক্তিদের আসামি করে ফরিদপুর কোতয়ালী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন সুবল চন্দ্র সাহা। এর জের ধরে ওই বছর ৭ জুন ফরিদপুরে পুলিশের বিশেষ অভিযানে খন্দকার মোশাররফের বাড়ি থেকে সাজ্জাদ হোসেন ও ইমতিয়াজ হাসানসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ বিশেষ অভিযানের একদিন পর ৯ জুন ফরিদপুর শহর ছেড়ে ঢাকা চলে যান ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের তৎকালীন আওয়ামী লীগ মনোনীত সংসদ সদস্য ও সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
Leave a Reply